কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস | কুরআন সংকলনের ইতিহাস | al quran

কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস | কুরআন সংকলনের ইতিহাস | al quran

কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস | কুরআন সংকলনের ইতিহাস | al quran

কোরআন সংরক্ষণের ইতিহাস | কুরআন সংকলনের ইতিহাস | al quran


কুরআন সংরক্ষণ পদ্ধতি:

মানবজাতির প্রতি মহান আল্লাহর অমূল্য দান হচ্ছে আল-কুরআন। মহান আল্লাহ স্বয়ং এ কিতাবের হিফাযতকারী বলে ঘােষণা দিয়েছেন। তাছাড়া মহানবীর (স) আমলে তথা কুরআন নাযিল হওয়ার সময় এবং সকল যুগেই এর সুরক্ষার নির্ভরযােগ্য ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়ে আসছে। আল-কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা সম্পূর্ণ অবিকৃত ও রক্ষিত আসমানি কিতাব হিসেবে চির অম্লান। 

কুরআন মাজীদ দু'টি পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হয়:


১. স্মৃতি ভাণ্ডার: পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবের তুলনায় একমাত্র কুরআনই এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে, এর সুরক্ষার জন্যে কলম ও কাগজের তুলনায় অধিক নির্ভর করা হয় স্মৃতিভাণ্ডার তথা হাফিযদের স্মরণ শক্তির উপর। হাদিসে কুদসীতে বলা ومن عليك كتابا لا يغيلة الماء “আপনার প্রতি আমি এমন একটি কিতাব নাযিল করেছি যাকে পানি মুছে ফেলতে পারে না।” (সহীহ মুসলিম)

২, লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে: কুরআন নাযিল হওয়ার সাথে সাথে ওহী লেখক দ্বারা লিখে রাখা হতাে। এ ধারা পরবর্তী যুগে লিপিবদ্ধ ও মুদ্রণের মাধ্যমে পবিত্র কুরআন অবিকল লিখিত আকারে সুরক্ষিত হয়ে আসছে।


কুরআন সংরক্ষণের ইতিহাস:

মহানবীর (স) যুগে কুরআন সংরক্ষণ : মহানবীর (স) যুগে কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থাসমূহ ছিল-

(ক) কুরআন মুখস্তকরণ: কুরআন মাজীদ নাযিল হওয়ার সাথে সাথে মহানবী (স) মুখস্থ করে নিতেন এবং তা জিবরাঈল (আ)-কে শুনাতেন। সাথে সাথে সাহাবীগণকেও কণ্ঠস্থ করে স্মৃতিভাণ্ডারে সঞ্চিত করে রাখার নির্দেশ দিতেন।

(খ) পারস্পরিক পঠন-পাঠন ও শ্রবণ: অধিকতর সতর্কতার জন্য মহানবী (স) প্রতি বছর রামাযান মাসে জিবরাঈলের (আ) সাথে কুরআন পারস্পরিক পঠন-পাঠন ও শ্রবণ করতেন। তেমনিভাবে তিনি সাহাবীগণকে শুনাতেন আর সাহাবীগণও তাঁকে শুনাতেন।

(গ) ব্যাপক চর্চা, শিক্ষাদান:  সাহাবীগণের মধ্যে কুরআন মুখস্থ করা, স্মরণ রাখা এবং শিক্ষাদানের অদম্য আগ্রহ বিদ্যমান ছিল। পবিত্র কুরআনকে স্বীয় স্মৃতির মণিকোঠায় সুরক্ষিত রাখার নিমিত্তে হাজার হাজার সাহাবী সকল মগ্নতা ত্যাগ করে এ সাধনায় জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। নিয়মিত রাত জেগে তারা নফল নামাযেও তিলাওয়াত করতেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘােষণা “তারা রাতে আল্লাহর (কুরআনের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে থাকেন।” (আলে-ইমরান يتكون ايي اللي اناء الليل মহানবীর (স) সময় মদীনায় আরাে বেশ কয়েকটি মসজিদ কায়েম হয়েছিল। সেগুলােতে কুরআন শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। বহু সাহাবী মানুষকে কুরআন শিক্ষাদানে ব্যস্ত ছিলেন। অনেক মহিলা বিয়ের মােহরানা স্বরূপ স্বামীর নিকট কুরআন শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এভাবে ব্যাপক চর্চা ও শিক্ষাদানের বিপুল আগ্রহ ও তৎপরতার দ্বারা কুরআনের বাণী ছিল সকলের মুখে মুখে।

(ঘ) কুরআনের বাস্তব আমল মহানবী (স) এবং সাহাবীগণ কুরআনের প্রতিটি আয়াতের মর্ম বাস্তব জীবনে রূপায়িত করার চেষ্টা করতেন।

ঙ. কুরআন লিখন, উপকরণ ও বিন্যাস: মহানবী (স) এর যুগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সুচারুরূপে ওহী লিখন দফতর-এর মাধ্যমে কুরআনের লিখনের কাজটি করানাে হয়। তবে এ সময় কুরআন মাজীদ একই নুসখা বা পাণ্ডুলিপিতে একত্র করা হয়নি।.মহানবীর (স) যুগে কুরআন লিখনের উপকরণ ছিল গাছের বাকল, হাড়, চামড়া, পাথর, কাপড়, মিশরীয় ফোম বস্ত্র এবং তখনকার মতো আবিষ্কৃত এক প্রকার কাগজ। কুরআনের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময় নাযিল হয় এবং তা সুচারুরূপে লিখিত হয়। সূরার নামকরণ, ধারাবাহিকতা এবং কোন আয়াত কোন সূরার কোথায় লিখিত হবে তার সবকিছুই আল্লাহর নির্দেশ মােতাবেক সুবিন্যস্ত ছিল।


কুরআন সংরক্ষণ প্রথম খলীফার যুগে:

মহাবী (স)-এর যুগে কুরআনের যেসব পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়েছিল তা একই গ্রন্থে ছিল না বরং বিভিন্ন বস্তুর উপর বিক্ষিপ্তভাবে ছিল। এদিকে মহানবীর (স) তিরােধানের পর হযরত আবু বকরের খিলাফতের প্রথম দিকে ইসলাম বিরােধী চক্র ও ভণ্ড নবীর বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে কুরআনের বহু হাফিয শাহাদাতবরণ করেন। হযরত উমর (রা) কুরআন একত্রে গ্রন্থাবদ্ধ করে সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্বারােপ করলে হযরত আবু বকর (রা) তা সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

কুরআন সংরক্ষণ তৃতীয় খলীফার আমলে:

তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের (রা) আমলে আরব সীমান্ত পেরিয়ে পারস্য ও রােমের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কুরআনের পঠনে আঞ্চলিক ভাষা ও উচ্চারণের প্রভাব কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠে বিপ্ন দেখা দেয়। এ অবস্থা দেখে হযরত উসমান (রা) উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি নেতৃস্থানীয় সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে যায়িদ ইবনে সাবিত (র)-এর নেতৃত্বে একটি সংস্থা গঠন করেন। এ সংস্থা মূল পাণ্ডুলিপির অনুকরণে একই পঠন রীতিতে কুরআনের মাসহাফ তৈরি করেন। এবং তার অনুলিপি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। আর সতর্কতার জন্য পূর্বের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শুদ্ধ, অশুদ্ধ ও আঞ্চলিক উচ্চারণের কুরআনের সমস্ত অংশ বা কপি তলব করে নেওয়া হয়। আর তা আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। এভাবেই কুরআন মাজীদ সংরক্ষিত হয়।


পরবর্তীকালে কুরআন সংকলন:

কুরআনের পাঠ সহজতর করার জন্য হরকত সংযােজন করেন হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ। তারপর থেকে কুরআনে আর কোন কিছু অনুপ্রবেশ ঘটানাে হয়নি। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কুরআন হাফিযদের স্মৃতিভাণ্ডার এবং মুদ্রণ শিল্পের মাধ্যমে ও লিখিত আকারে নির্ভুলভাবে সংরক্ষিত রয়েছে এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

মহানবীর (স) যুগে:
মহানবী (স)-এর উপর ওহী নাযিল হওয়ার সময়ে পবিত্র কুরআনকে একখানি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপদান করা সম্ভব হয়নি। কারণ তখনও কুরআন নাযিল হচ্ছিল। এ সময় কুরআন নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তা লিখে রাখা হতাে। ওহী লেখকদের সংখ্যা ছিল ৪২ জন। ওহী লেখকগণ রাসূলের (স) কাছে থাকতেন এবং যখন যা নাযিল হতাে তা লিখে রাখতেন।

প্ৰথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর যুগে:
মহানবীর (স) ইতিকালের পর ইসলাম জাহানের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফত আমলে ভণ্ড নবীর বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদে বিশেষত ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনের অনেক হাফিয সাহাবী শাহাদাতবরণ করেন। এভাবে হাফিযগণ শাহাদাতবরণ করতে থাকলে কুরআন মাজীদ সংরক্ষণ করা দুরূহ হয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া কুরআনের অংশবিশেষ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দূরদর্শী হযরত উমর (রা) খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-কে কুরআন সংগ্রহ করে একই গ্রন্থে গ্রন্থাবদ্ধ করার প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরেন। হযরত উমরের (রা) পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। হযরত আবু বকর (রা) মহানবী (স) যে কাজটি করে যেতে পারেননি, তা করার সীমাহীন গুরুত্ব ও কল্যাণের দিক বিবেচনা করে এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং কুরআন গ্রন্থাবদ্ধ করার মহতী কাজে হাত দেন। মহানবীর (স) ওহী লিখন দফতরের প্রধান হযরত যায়িদ ইবনে সাবিত (রা)-এর নেতৃত্বে একটি কুরআন গ্রন্থায়ন কমিশন গঠন করেন। মুসলিম জাহানের সর্বত্র ফরমান জারি করেন যে, যার কাছে কুরআনের যে অংশ রয়েছে, তা এ কমিশনের নিকট জমা দিতে। কমিশন' মহানবীর (স)-এর জীবদ্দশায় লিখিত পাণ্ডুলিপি অনুসরণে এবং সর্বস্তরের লােকের সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে হাফিযদের স্মৃতিতে সুরক্ষিত তরতীব অনুসরণ করে বিশিষ্ট সাহাবীদের প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় আল- কুরআনের সূরা ও আয়াতসমূহ সংগ্রহ করে একখানি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্য পাণ্ডুলিপি গ্রন্থাকারে রূপদান করেন। একে রাষ্ট্রীয়ভাবে হিফাযত করা হয়। পরে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমরের (রা) ইনতিকালের পর নবীপত্নী উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসার (রা) নিকট তা সংরক্ষিত থাকে।


অভিন্ন পাঠরীতিতে কুরআন গ্রন্থাবদ্ধকরণ:

তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) খিলাফতকালে ইসলাম আরব সীমান্ত পেরিয়ে পারস্য ও রােমের বিস্তীর্ণ এলাকায় বিস্তার লাভ করে। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ফলে বিভিন্ন জাতি ও ভাষা-ভাষীর লােক ইসলাম গ্রহণ করে। অনারব লােকেরা কুরাইশদের ভঙ্গিতে কোন কোন আরবি শব্দের উচ্চারণ করতে পারত না। আঞ্চলিক উচ্চারণের প্রভাবে কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠে পার্থক্য দেখা দেয়। হযরত উসমান (রা) ব্যাপারটির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তিনি নেতৃস্থানীয় সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে ওহী লিখন ও গ্রন্থাবদ্ধ করার কাজটি যারা করেছেন, তাঁদের সমন্বয়ে যায়িদ বিন সাবিতের (রা) নেতৃত্বে একটি সংস্থা গঠন করেন। এ সংস্থাকে কতকগুলাে মূলনীতির একই পাঠরীতির কুরআনের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতে বলেন। এ সংস্থার কাজ ছিল-

(ক) প্রথম খলিফা হযরত আবু বকরের (রা) আমলের মূল পাণ্ডুলিপি অনুকরণে সূরার ক্রমানুসারে একই মাসহাফে সন্নিবেশ করা।

(খ) মহানবীর (স) যুগে এমন পদ্ধতিতে কুরআন লেখা হত, যাতে প্রসিদ্ধ সকল কিরাআত পদ্ধতিতে কুরআন পাঠ করা যেত। কিন্তু পরে এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তাই এ সংস্থা কেবল একই পঠন পদ্ধতিতে কুরআনের মাসহাফ প্রস্তুত করেন।

(গ) এ সংস্থা কুরআনের সর্বসম্মত ও নির্ভরযােগ্য প্রামাণ্য পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করে প্রাদেশিক গভর্নরদের কাছে প্রেরণ করে সরকারিভাবে তারই অনুসরণ করার নির্দেশ জারি করে।

(ঘ) এ সংস্থা আবু বকরের (রা) সময়ের মূল পাণ্ডুলিপিটিও পুনঃপরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং যাচাই-বাছাই করে দেখেন।

(ঙ) মূল পাণ্ডুলিপি রেখে কুরআনের অন্য সব অংশ বা পাণ্ডুলিপি ছিল তা তলব করে নেওয়া হয়। অধিকতর সতর্কতার জন্য তা আগুনে পুড়িয়ে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়। এভাবেই কুরআন মাজীদ তৃতীয় খলীফা হযরত উসমানের (রা) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একই পঠনরীতিতে গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়।
Next Post Previous Post