বাদশা হারুন অর রশিদ এর জীবনী | বাদশা হারুন | বাদশা হারুন অর রশিদ | বাদশা হারুনুর রশিদের জীবনী | বাদশাহ হারুন অর রশিদ | বাদশাহ হারুনুর রশিদের জীবনী | বাদশা হারুন এর জীবনী | badshah harun rashid

বাদশা হারুন অর রশিদ এর জীবনী | বাদশা হারুন | বাদশা হারুন অর রশিদ | বাদশা হারুনুর রশিদের জীবনী | বাদশাহ হারুন অর রশিদ | বাদশাহ হারুনুর রশিদের জীবনী | বাদশা হারুন এর জীবনী | badshah harun rashid

বাদশা হারুন অর রশিদ এর জীবনী | বাদশা হারুন | বাদশা হারুন অর রশিদ | বাদশা হারুনুর রশিদের জীবনী | বাদশাহ হারুন অর রশিদ | বাদশাহ হারুনুর রশিদের জীবনী | বাদশা হারুন এর জীবনী | badshah harun rashid

পরিচয়

বিশ্ব ইতিহাসে যে কয়জন শাসকের নাম সােনালী গৌরবে সমুজ্জ্বল, আব্বাসীয় খলিফা হারুন-অর-রশিদ তাঁদের অন্যতম। কিংবদন্তি সহস্র রজনীর বাগদাদের স্রষ্টা এই হারুন-অর-রশিদ। তাঁর খিলাফত কালে সকল দিক দিয়েই ইসলামের ইতিহাসে এক সােনালী অধ্যায়ের সূচনা হয়। তাঁর সমসাময়িক রাজা-বাদশাহের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, সমরকুশলী, প্রজারঞ্জক, সুশাসক এবং বিদ্যোৎসাহী। সর্বদিক দিয়ে তাঁর খিলাফতকাল ছিল আব্বাসীয় রাজত্বের স্বর্ণযুগ।


খিলাফত লাভ ও প্রাথমিক কার্যাবলী:

হারুন-অর-রশিদ ভ্রাতা হাদীর মৃত্যুর পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে ৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের সিংহাসনে বসেন। তাঁর খিলাফত লাভের পরে হারুন তাঁর মা খায়জুরানকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে সকল সুযােগ-সুবিধা প্রদান করেন। তার মা ছিলেন ইয়াহিয়া বিন-খালিদ বামেকীর পৃষ্ঠপােষক। এজন্য হাদী তাঁর মাকে সুযােগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছিলেন এবং ইয়াহিয়া বার্মেীকে কারারুদ্ধ রেখেছিলেন। হারুন তাঁর বাল্য শিক্ষক ইয়াহিয়া বিন খালিদ বার্মেীকে মায়ের ইচ্ছানুসারে সসম্মানে মুক্তি দেন এবং উজীর পদে নিয়ােগ করেন। বার্মেকীর দুই পুত্র ফজল ও জাফরকে উচ্চ রাজপদ দান করেন। হারুনের মা খায়জুরানের পৃষ্ঠপােষকতায় বামেকী পরিবার হারুনের রাজত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে রাখে।

অভ্যন্তরীণ নীতি:

হারুন-অর-রশিদ খিলাফত লাভের পর অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বিশৃক্মখলার সম্মুখীন হন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃক্মখলা ও সংহতি প্রতিষ্ঠার দিকে মনােযােগ দেন। এজন্য তিনি দমন নীতি গ্রহণ করেন। যেমন-


খারিজি বিদ্রোহ দমন:

হারুন-অর-রশিদ সিংহাসনে বসার পর প্রথমে খারিজিদের বিদ্রোহের কবলে পড়েন। খারিজিরা বারবার বিদ্রোহ ও গােলযােগ সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যের শান্তি বিনষ্ট করে। প্রথমে ৭৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দে মসুলে খারিজি বিদ্রোহ দেখা দেয়। তারা মেসােপটেমিয়ার রাজধানী দখল করে নেয়। মেসােপটেমিয়ার আব্বাসীয় শাসনকর্তা আবু হুরাইরা এ বিদ্রোহ দমন করতে না পারায় খলিফা তাঁকে হত্যার আদেশ দেন।

খারিজি নেতা ওয়ালিদ-বিন তারিকের নেতৃত্বে খারিজিগণ আর্মেনিয়া ও আজারবাইযানে ব্যাপক গােলযােগ সৃষ্টি করে। ৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে খলিফা হারুন এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে ওয়ালিদকে পরাজিত ও নিহত করেন। ওয়ালিদের নিহত হওয়ার পর তাঁর বােন লায়লা খারিজিদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। লায়লার নেতৃত্বে খারিজিরা ইরাকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেয়। বারবার খলিফার বাহিনী তাঁর কাছে পরাজিত হয়। অবশেষে বীরশ্রেষ্ঠ লায়লা খলিফার জনৈক সেনাপতির প্রচেষ্টায় পারিবারিক জীবনে ফিরে গেলে খারিজি বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে। বীরত্বের জন্য লায়লা ইতিহাসে আরবীয় জোয়ান অব আর্ক (Joan of Arc) নামে খ্যাতি লাভ করেন। শােকাভিভূত লায়লা ভাইয়ের রােমাঞ্চকর অভিযানের শােকগাঁথা রচনা করে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।


পারস্যের খারিজিদের দমন: ৭৯৬-৯৭ খ্রিস্টাব্দে অপর একটি খারিজি বিদ্রোহ পারস্য অঞ্চলে বিশৃক্মখলা সৃষ্টি করে। সেখানকার শাসনকর্তা আলী ইবনে ঈসা তা কঠোরভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেন। এভাবে খলিফা হারুন খারিজি বিদ্রোহ দমন করে সাম্রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।

মধ্য এশিয়ায় শান্তি স্থাপন: ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে গােটা কাবুল ও সানবাদ আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। এ সময় মুসলিম সাম্রাজ্য হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তারপর খলিফা এশিয়া মাইনরের সীমান্ত অঞ্চলগুলােকে সাধারণ প্রদেশসমূহ হতে আলাদা করে ‘আওয়াসিম বা সুরক্ষিত এলাকা' নাম দিয়ে একে একজন সামরিক শাসনকর্তার হাতে ন্যস্ত করেন। তিনি সিরিয়ার সাসে পুনরায় বসতি স্থাপন করে একে একটি সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত করেন।


আলীপন্থীদের প্রতি তাঁর নীতি:  আব্বাসীয় খিলাফতে আলীপন্থীদের বিরােধিতা ন্যায়সঙ্গত ছিল। কারণ তারা আল- আব্বাস ও আল-মনসুর কর্তৃক প্রতারিত ও নির্যাতিত হয়েছিল। আল-মনসুর ইবরাহীম ও মুহাম্মাদকে হত্যা করলে তাদের ছােট ভাই ইয়াহইয়া দাইলাম এলাকায় আলাপন করে থাকেন। খলিফা হারুনের সময়ে ইয়াহইয়া বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। খলিফা পারস্যের শাসনকর্তা ফজল বার্মাকীকে দিয়ে তাকে দমন করার চেষ্টা করেন।

ইয়াহইয়াকে বন্দীকরণ:  বার্মাকী পরিবার আলীপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তাই ইয়াহইয়াকে খলিফার বশ্যতা স্বীকার করতে বলা হয়। এক চুক্তিতে খলিফা হারুনের সাথে ইয়াহইয়ার মৈত্রী স্থাপিত হয়। কিন্তু খলিফা হারুন বিদ্রোহের সমস্ত সম্ভাব্য উৎসকে নির্মূল করার জন্য ইয়াহইয়াকে বন্দী করে রাখেন। শিয়াদের বিদ্রোহের ভয়ে হারুন সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধক ও মহাপণ্ডিত ইমাম মূসা আল-কাযিমকে পর্যন্ত বন্দী করে বাগদাদের সিন্ধি-ইবন-শাহিকের বােনের পাহারায় রাখেন। কয়েক বছর কারাভােগ করার পর তিনি ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে। ইনতিকাল করেন। ইমাম মূসা আল-কাযিমের ইনতিকালের পর তাঁর সুযােগ্য পুত্র আলী আলতায় শিয়াদের পরবর্তী ইমাম নিযুক্ত হন।


মুদারীয় ও হিমারীয়দের প্রতি দমননীতি:  ৭৯২ খ্রিস্টাব্দে মুদারীয় ও হিমারীয়দের মধ্যে সিরিয়া ও সিন্ধু অঞ্চলে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। খলিফা হারুন সেনাপতি মূসার দ্বারা সিরিয়ার এবং সেনাপতি দাউদের দ্বারা সিন্ধু প্রদেশের বিদ্রোহ দমন করে শান্তি আনয়ন করেন।

মসুলের বিদ্রোহ দমন: ৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে আতাফের নেতৃত্বে মসুলে বিদ্রোহ দেখা দিলে খলিফা নিজেই সেনাবাহিনী পরিচালনা করে তাকে দমন করেন। খলিফা তাদের শাস্তিস্বরূপ মসুলের প্রাচীরগুলাে ভেঙ্গে দেন।


খাজার বিদ্রোহ দমন: ৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রীকদের প্ররােচনায় খাজার উপজাতিরা আর্মেনিয়া আক্রমণ করে। খলিফা হারুন দুজন দক্ষ সেনাপতি পাঠিয়ে তাদেরকে কঠোর হাতে দমন করেন। আফ্রিকায় আগলাবীয় শাসন প্রতিষ্ঠা ও খলিফা হাদীর সময়ে ৭৮৫-৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার তানজিয়ারে আলী বংশীয় ইদরীস নামে এক ব্যক্তি স্পেনে ইদরিসীয় বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় থেকে আব্বাসীয় শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এলাকাটি স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। আফ্রিকার আব্বাসীয় শাসনকর্তাগণ বহুবার চেষ্টা চালিয়েও তা পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। খলিফা হারুন ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সেনাপতি হারসামাকে উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। হারসামা প্রায় তিন বছর যােগ্যতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করে তিনি সেখানে শান্তি ও শৃক্মখলা প্রতিষ্ঠা করেন।

এ সময়ে দক্ষিণ আলজেরিয়ার জাব অঞ্চলের শাসনকর্তা ইবরাহিম-ইবনে- আগলাব পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে খলিফার প্রিয়ভাজন হন। তিনি খলিফা হারুনের নিকট প্রস্তাব দেন উক্ত প্রদেশের শাসনভার যদি তার বংশধরদেরকে স্থায়ীভাবে দেয়া হয়, তবে তিনি শান্তি-শৃক্মখলা স্থাপন করবেন এবং বার্ষিক ৪০ হাজার দীনার বশ্যতামূলক কর' হিসেবে বাগদাদকে দেবেন। দূরদর্শী হারুন উত্তর আফ্রিকার ব্যয়বহুল শাসনের কথা বিবেচনা করে এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আফ্রিকান আগলাবীয় বংশের হাতে উত্তর আফ্রিকার শাসনভার অর্পণ করেন। তখন থেকে উত্তর আফ্রিকা একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশে পরিণত হয়।

হারুনের বৈদেশিক নীতি:


বাইজানটাইনদের সাথে যুদ্ধ: এটা ছিল হারুনের রাজত্বে একটা চমৎকার ঘটনা। তাঁর পিতার রাজত্বকালেই হারুন বাইজানটাইন সম্রাজ্ঞী আইরিনকে পরাজিত করে কর প্রদানে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু নতুন সম্রাট নাইসিফোরাস খলিফার নিকট এক অপমানজনক পত্রে তাঁর পূর্ববর্তী সম্রাজ্ঞীর প্রদত্ত সমুদয় করের দ্বিগুণ অর্থ দাবি করেন। খলিফা হারুন এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিশাল বাহিনী নিয়ে নাইসিফোরাসকে পরাজিত ও কর প্রদানে বাধ্য করেন। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নাইসিফোরাস তিনবার চুক্তিভঙ্গ করে। খলিফা প্রত্যেকবারই তাঁকে পরাজিত করেন এবং তাঁর সন্ধির প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। তৃতীয়বারে বর্ধিত কর ছাড়াও নাইস ফোরাস ও তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্য কর দিতে বাধ্য হন। নাইসিফোরাসকে বার বার ক্ষমা প্রদর্শন একদিকে খলিফার মহানুভবতার পরিচয় বহন করে অপরদিকে এটা তার চরম অদূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। মুর বলেন- “হারুন ঘন ঘন অন্যত্র ব্যস্ত থাকলে নাইসিফোরাস তাঁর সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করেন এবং প্রতিবারেই পরাজিত হন। নাইসিফোরাস ধৃষ্ঠতা, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা করলেও খলিফা হারুন প্রতিবারেই তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন করে অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন।”

কূটনৈতিক সম্পর্ক: হারুন-অর-রশিদের সুনাম সুখ্যাতি তত্ত্বালীন বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু রাজন্যবর্গের সাথে তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। চীন সম্রাট ‘ফাগফুর' দূত প্রেরণ করে তার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। তিনি ভারতের সাথেও দূত ও উপঢৌকন আদান-প্রদান করেন। ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেনের সাথে তিনি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। হারুন শার্লিমেনকে একটি অত্যাশ্চর্য কারুকার্য খচিত পানিঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন।


বাদশা হারুনের কৃতিত্ব ও চরিত্র:


কৃতিত্ব:
হারুন অর রশিদ আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নরপতিগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালকে ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয় ।

শ্রেষ্ঠ নরপতি: খলিফা হারুন একজন উদার, সদাশয়, ন্যায়বিচারক ও প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন। অন্যায়কারী ও বিদ্রোহীদের প্রতি তিনি যেমন ছিলেন কঠোর, তেমনি গরিব-দুঃস্থদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল।

সমর কুশলী:  যােদ্ধা হিসেবেও হারুন অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আব্বাসীয় খিলাফতকে বিপদমুক্ত করার জন্য তিনি একটি বিশাল ও সুদক্ষ সেনাবাহিনী গঠন করেন। অরাজকতা, বিশৃক্মখলা ও বিদ্রোহ দমন করার জন্য তিনি দক্ষতা ও রণ কুশলতার পরিচয় দেন। তিনি নিজেও সৈন্য পরিচালনা করেন।


শাসন ব্যবস্থা:  দীর্ঘ তেইশ বছরকাল হারুন-অর-রশিদ আব্বাসীয় খিলাফতের শাসন দণ্ড দৃঢ়হস্তে পরিচালনা করেন। হারুন খিলাফতের সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার গুরু দায়িত্ব পারস্যের বিখ্যাত বাৰ্মাকী পরিবারের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন।

জনহিতকর কার্যাবলী: অরাজকতা দমন এবং প্রজাদের অবস্থা স্বয়ং অবগত হবার জন্য তিনি ছন্দবেশে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করতেন। জনসাধারণের সুবিধার্থে খলিফা সাম্রাজ্যের সর্বত্র অসংখ্য স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট প্রভৃতি নির্মাণ করেন। জনদরদী ও প্রজাহিতৈষী খলিফা হারুন সাধারণ মানুষের অবস্থা স্বচক্ষে অবলােকন করার জন্য রাতে ছদ্মবেশে শহরে পরিভ্রমণ করতেন। তিনি জনসাধারণ, তীর্থযাত্রী ও ব্যবসায়ীদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করেন। তিনি দশ।লক্ষ দীনার ব্যয়ে মক্কা নগরীতে পানি সরবরাহের জন্য “নাহরে যুবাইদা” নামে একটি প্রসিদ্ধ খাল খনন করেন। হিট্টি বলেন, “ফার্দিনান্দ দিলেসেপের এক হাজার বছর আগে হারুন নামে একজন আবর্য খলিফা সুয়েজের অভ্যন্তর দিয়ে একটি খাল খননের পরিকল্পনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাগদাদে হাসপাতাল নির্মাণ করেন।


শিল্প ও বাণিজ্যের পৃষ্ঠপােষকতা:  খলিফা হারুনের সময় স্থাপত্য শিল্পের চরম বিকাশ ঘটে। বাগদাদের পণ্য বিশ্ববিখ্যাত ছিল। ব্যবসায় বাণিজ্যের পৃষ্ঠপােষণের ফলে বাগদাদ নগরী ছিল বিশ্বের ধনী ও বণিক শ্রেণীর লােভনীয় স্থান। তিনি ৭৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে কাগজের কল স্থাপন করেন।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতা: খলিফা হারুন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তার সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাঁর আমলে বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত মনীষীগণের মিলনভূমি ছিল বাগদাদ। হিট্টি বলেন, “এই যুগ পৃথিবীর ইতিহাসকে যে কারণে গৌরবােজ্জ্বল করেছে তা হচ্ছে, এ আমলই ইসলামের ইতিহাসের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বাপেক্ষা উৎকর্ষের যুগ। তাঁর পৃষ্ঠপােষকতায় মনসুরের প্রতিষ্ঠিত অনুবাদ বিভাগ সম্প্রসারিত হয়। হারুনের পৃষ্ঠপােষকতায় প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফের নেতৃত্বে হানাফী মাযহাব আত্রকাশ করে। ইমাম বুখারী হাদীস শাস্ত্র প্রণয়ন করেন। আবু নুয়াস ও আতাইয়া সাহিত্যে এবং আসমায়ী ব্যাকরণে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।” খলিফার নির্দেশে আর পণ্ডিতগণ গ্রীকসহ প্রভৃতি ভাষার বিজ্ঞান ও দর্শনের গ্রন্থরাজী আরবী ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি ‘মানকা' নামক ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদকে বাগদাদে আমন্ত্রণ করেন। সঙ্গীতজ্ঞ ও নৃত্য শিল্পীগণও হারুনের দরবারকে অলংকৃত করত। এ সময়ে রচিত হয় বিখ্যাত আরব্য উপন্যাস। ঐতিহাসিক গীবন।বলেন- আরব্যোপন্যাস ব্যতীত- ‘রবিনসন ক্রুসাে' এবং সম্ভবত গ্যালিভারের ভ্রমণ কাহিনী রচিত হত না।'


হানাফী মাযহাবের পৃষ্ঠপােষকতা:  খলিফা হারুনের খিলাফতে হানাফী মাযহাব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। খলিফার প্রধান কাজী ইমাম আবু ইউসুফ তাঁর শিক্ষক ইমাম আবু হানীফার ফিকাহ শাস্ত্রীয় বিধান ও আইন-কানুনসমূহ লিপিবদ্ধ করে মুসলমানদের শ্রদ্ধার পাত্র হন।

বাগদাদের প্রাচুর্য: খলিফা হারুনের রাজত্বকালে বাগদাদ তদানীন্তন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাঁকালাে ও সমৃদ্ধিশালী নগরীতে পরিণত হয়। সুরম্য রাজপ্রাসাদ, অট্টালিকা, মনােরম সৌধরাজি, সুসজ্জিত হেরেম, নয়নাভিরাম বাগিচা ও ভ্রমণােদানসমূহ বাগদাদকে রূপকথার স্বপ্নপুরীতে পরিণত করেছিল। সে আমলের সমগ্র পৃথিবীতে বাগদাদের সমকক্ষ নগর আর একটি খুঁজে পাওয়া যায় না। বাগদাদের পণ্য ছিল বিশ্ববিখ্যাত। সমুদ্র বন্দর হিসেবে বাগদাদের সুদীর্ঘ পােতাশ্রয় জুড়ে শত শত জাহাজ শােভা পেত। বাগদাদের বাজারসমূহ সমৃদ্ধ থাকত চীনামাটির বাসন-কোসন, তৈজস পত্র, সিল্কের কাপড় ও মুখােশ, ভারত ও মালয়ের মসলা, খনিজ পদার্থ ও রঙ, মধ্য এশিয়ার রুবী, নীলবর্ণের মূল্যবান পাথর, উন্নত বস্ত্র, রাশিয়ার মধু, ভেড়ার ললাম, আফ্রিকার হাতির দাঁতে। তাছাড়া দেশ-বিদেশের নানা পণ্য সামগ্রীতে বাগদাদের বাজার ছিল পরিপূর্ণ


কূটনৈতিক দিক:  খলিফা হারুনের সুনাম ও সুখ্যাতি তৎকালীন বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর রাজত্বকালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু রাজ দরবারের সাথে কূটনৈতিক এবং বন্ধুত্বমূলক যােগাযােগ স্থাপিত হয়। ইসলামের তথা তদানীন্তন গােটা বিশ্বের ইতিহাসে খলিফা হারুন-অর-রশীদ ছিলেন এক দীপ্তিমান নক্ষত্র। তাঁর রাজত্বকালে মুসলিম সাম্রাজ্য ঐশ্বর্য ও গৌরবের স্বর্ণশিখরে আরােহণ করে।

চরিত্র:
খলিফা হারুন-অর-রশীদ অসামান্য প্রতিভা, অসাধারণ দক্ষতা ও অতুলনীয় চারিত্রিক মাহান্ত্রে অধিকারী ছিলেন। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মূর বলেন, "Harun was perhaps the ablest ruler of the Abaside race. He is liked to Abu Jafar but without his parsimony.

ধর্মভীরুতা:  ব্যক্তিগত জীবনে খলিফা ছিলেন ধর্মভীরু, সদাশয় ও দানশীল। তিনি প্রত্যহ নির্ধারিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায ছাড়াও প্রতি রাতে একশত রাকায়াত নফল নামায পড়তেন। তেইশ বছরের শাসনকালে তিনি নয় বার হজব্রত পালন করেন।


কঠোরতা ও কোমলতার সংমিশ্রণ: খলিফা হারুনের চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। রাজ্যের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য যতটুকু কঠোরতার প্রয়ােজন ছিল তিনি ততটুকু গ্রহণ করেছিলেন। তিনি অন্যায়কারী ও বিদ্রোহীদের প্রতি যেমন কঠোর ও নির্দয় ছিলেন তেমনি গরিব, দুঃস্থ, অসহায়ের প্রতি সদয় ছিলেন।

সন্দেহপরায়ণতা:  তাঁর চরিত্রে বিভিন্ন রাজোচিত গুণাবলীর সমাবেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি বংশানুক্রমিক ধৈর্যহীনতা এবং সন্দেহপরায়ণতা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন না। শিয়া ইমাম মূসা আল-কাযিমকে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কারারুদ্ধ করা এবং পরম বিশ্বস্ত বার্মাকী পরিবারের প্রতি কৃতঘ্ন নিষ্ঠুরতা তাঁর মহানুভব চরিত্রের উপর কলঙ্ক কালিমা লেপন করেছে। সৈয়দ আমীর আলী বলেন, “হারুন অর রশীদের চরিত্রের প্রধান দোষ ছিল তাঁর আকস্মিক সন্দেহপরায়ণতা, অযথা ধৈর্যহীনতা।" ঐতিহাসিক উইলিয়াম মূর বলেন, আব্বাসীয় গােষ্ঠীর মধ্যে সম্ভবত হারুনই সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। আবু জাফরের চরিত্রের নিষ্ঠুরতার দিকটি বাদ দিলে শুধু তাকেই হারুনের সাথে তুলনা করা যায়।

112

ইতিহাসে হারুনের স্থান:
ঐতিহাসিক সমালােচনার মানদণ্ডে পরিমাপ করলে আমরা দেখতে পাই যে, চরিত্র মাহাত্ম শাসন-কুশলতায় হারুন- অর-রশীদ ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম। ঐতিহাসিক গীবন তাঁকে আব্বাসীয় বংশের সর্বাপেক্ষা প্রতিভাবান খলিফা বলে আখ্যায়িত করেছেন। খলিফা হারুনের গৌরবদীপ্ত কীর্তিকলাপ Arabian Nights বা আরব্যোপন্যাস-এর রােমাঞ্চকর কাহিনীগুলাের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। খলিফা হারুনের শাসনকালকে ঐতিহাসি  উইলিয়াম মূরের ভাষায় মন্তব্য করা যায় যে, হারুনের পূর্বে অথবা পরে কোন খলিফাই বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যে- তা ধর্ম পালনেই হােক বা শাসন পরিচালনায়ই হােক অথবা সমর ক্ষেত্রেই হােক তার ন্যায় এত কর্মতৎপরতা ও উদ্যমশীলতা প্রদর্শন করতে পারেননি। হিট্টি বলেন, “নবম শতাব্দীর প্রথম দিকে বিশ্বপরিক্রমার দু'জন নৃপতি ভাস্বর হয়ে আছেন- পাশ্চাত্যের শার্লিমেন এবং প্রাচ্যে হারুন। উভয়ের মধ্যে নিঃসন্দেহে হারুন অধিকতর ক্ষমতাশালী ও সংস্কৃতিবান ছিলেন। সুতরাং সত্যিই হারুন-অর-রশীদ ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতিদের অন্যতম মহান নৃপতি।

Tag: বাদশা হারুন অর রশিদ এর জীবনী, বাদশা হারুন, বাদশা হারুন অর রশিদ, বাদশা হারুনুর রশিদের জীবনী, বাদশাহ হারুন অর রশিদ, বাদশাহ হারুনুর রশিদের জীবনী, বাদশা হারুন এর জীবনী, badshah harun rashid
Next Post Previous Post