শক্তিশালী বাদশা আবরাহা ও ছােট পাখি আবাবিল | বাদশা আবরার ঘটনা | হস্তী বাহিনীর ঘটনা | কাবা ধ্বংসের ইতিহাস | Abra Badsha Kaba Akromon

বাদশাহ আবরাহা ও ছােট পাখি আবাবিল | বাদশা আবরার ঘটনা | হস্তী বাহিনীর ঘটনা | কাবা ধ্বংসের ইতিহাস | Abra Badsha Kaba Akromon

শক্তিশালী বাদশাহ আবরাহা ও ছােট পাখি আবাবিল | বাদশা আবরার ঘটনা | হস্তী বাহিনীর ঘটনা | কাবা ধ্বংসের ইতিহাস | Abra Badsha Kaba Akromon
বাদশা আবরাহা ও আবাবিল পাখি

৫৭০ কি ৫৭১ সাল। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ । মক্কানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এ বছরেই। হিজরি রবিউল আউয়াল মাসে। আর এ বছরের মহরম মাসে ঘটে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ঘটনাটি কুরআনুল কারিমের সূরা ফিলের আলােকে বলা যায় আসহাবুল ফিল বা হস্তী বাহিনীর ঘটনা।

আবরাহা ছিলাে একজন ক্রীতদাস। ধীরে ধীরে তার বুদ্ধিমত্তা ও চাতুর্যতা তাকে ইয়েমেনের বাদশাহর আসনে বসায়। তার প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়ে গিয়েছিলাে অনেক। প্রভাব আর প্রতিপত্তি তাকে করলাে বেপরােয়া । শুরু করলাে ধরাকে সরা জ্ঞান করার । মহা শক্তিধর বাদশাহর অভিপ্রায় জাগলাে । ইয়ামেনের রাজধানী সানআয় একটি বিশাল আকৃতির গির্জা তৈরি করলাে। আরব ঐতিহাসিকগণ একে আলকালীস অথবা আলকুল্লাইস বলে উল্লেখ করেছেন। গির্জার কাজ সমাপ্ত করে হাবশার বাদশাহকে লিখলেন, আমি আরবের হজ্বকে মক্কার পরিবর্তে সানআ’র গির্জার দিকে ফিরানাে পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না। সদর্পে ঘােষণা করলাে আবরাহা সবখানে। উদ্দেশ্য একটাই যাতে মক্কার লােকেরা এটা আক্রমণ করে। আর সে সুযােগে কা'বা আক্রমণ করা যায় খুব সহজেই।


তাই হলাে। জনৈক আরব সুযােগ বুঝে গির্জায় প্রবেশ করে মলত্যাগ করে। আর এ কাজটি করেছিলাে একজন কুরাইশ যুবক। কারাে মতে কয়েকজন যুবক গির্জায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাে। আবরাহার উত্তেজনাকর ঘােষণায় এর কোনােটা ঘটাই অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর নয়। আবার এসব ঘটনা ঘটানাে আবরাহার নাটক হওয়াও অস্বাভাবিক তবে ঘটনা যাই হােক। বাদশাহ আবরাহার কাছে কা'বা ভক্ত অনুরুক্ত দ্বারা গির্জা অবমাননার রিপোের্ট পৌছলাে ।

কসম খেয়ে বসলাে বাদশাহ আবরাহা। আবরাহা শপথ করে নিলাে । কাবাকে মাটির সাথে না গুঁড়িয়ে স্থির হয়ে বসবাে না। শুরু হলাে কথা অনুযায়ী কাজ। ষাট হাজার পদাতিক এবং নয়টি কিংবা তেরােটি হাতি নিয়ে কাবা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে মক্কার পথে হলাে রওয়ানা । যাত্রা বাঁধাপ্রাপ্ত হলাে ইয়ামেনের আরব সরদার যু-নফরের সেনাদল কর্তৃক। পরাভূত ও পরাজিত হলাে তিনি। তারপর বাধাগ্রস্ত হলাে খাশ আম এলাকায় নুফাইল ইবনে হাবীব খুশয়ামী কর্তৃক। কিন্তু তার ভাগ্যে জুটে পরাজয়ের গ্লানী । খাশয়ামীকে বাদশাহ আবরাহার সেনাবাহিনী করে গ্রেফতার। নিজের জীবন বাঁচানাের জন্য সে পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। যুদ্ধংদেহী মনােভাব নিয়ে এগিয়ে আসলাে আবরাহার হস্তীবাহিনী তায়েফের উপকণ্ঠে।


বনুসকীফ গােত্রের নেই প্রতিরােধের ক্ষমতা। তাদের সরদার মাসউদ একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে গেলেন বাদশাহ আবরাহার কাছে। বিনয়ের সাথে তার আশংকা থেকে বললেন, আপনি যে উপসনালয়টি ধ্বংস করতে এসেছেন তা এটি নয়। এটি আমাদের মন্দির। আর সেটি মক্কায় অবস্থিত কা'বা । আপনি আমাদেরটায় হাত দিবেন না। আপনার পথপ্রদর্শনের জন্য আবু রিগালকে দেবাে আপনার সাথে। আবরাহা তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করলাে আনন্দচিত্ত আর খুশি ভরা মনে।

মক্কায় যাওয়ার আর মাত্র তিন ক্রোশ বা ছত্রিশ মাইল পথ বাকি। পথপ্রদর্শক আবু রিগাল পথিমধ্যে মাগাম্মাস বা আল মুগাম্মিস স্থানে মারা যায়। শুরু হয় আবরাহার ছন্দ পতন। যুগ যুগ ধরে আরবরা প্রতিশােধের পাথর মেরেছে আবু রিগালের কবরে। অভিশাপ দিয়েছে বনু সাকীফ গােত্রকে। বাদশাহ আবরাহাকে কাবা দেখিয়ে দেয়ার অপরাধে। মাগাম্মাস থেকে লুটে নেয় আবরাহা বাহিনী তিহামাবাসী ও কুরাইশদেরও বহু সংখ্যক উট, ছাগল ও ভেড়া ইত্যাদি।


লুট করা সম্পদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা: এর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের দুশাে উট ছিলাে। বাদশাহ আবরাহা দূত পাঠায় আরব সরদার আব্দুল মুত্তালিবের কাছে। দূতের সাথে বীর দর্পে চলে এলেন আব্দুল মুত্তালিব। বাদশাহ আবরাহার কাছে। বাদশাহ আবরাহা তাকে বললাে, আমি যুদ্ধ করতে আসিনি। এসেছি কাবা ধ্বংসের জন্য। তােমরা যদি যুদ্ধ না করাে তােমাদের প্রাণ ও সম্পদ থাকবে নিরাপদ। আপনি এখন কী চান? প্রতি উত্তরে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আব্দুল মুত্তালিব বললেন । তােমার সাথে যুদ্ধ করার শক্তি ও সাহস আমাদের নেই। এটা আল্লাহর ঘর তিনি চাইলে রক্ষা। করবেন। তবে আমার দু'শাে উট তােমার লােকেরা এনেছে। আমি আমার উটগুলাে ফেরত চাই।

বাদশাহ আব্রাহা তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। আপনি শুধু উট চাচ্ছেন? অথচ আপনার ও আপনাদের ইজ্জতের কেন্দ্রবিন্দু পবিত্র কাবা। আবার ধর্মীয় উপাসনালয়ও বটে। এটা আমার কাছে বড়ই তাজ্জব লাগছে । আব্দুল মুত্তালিব সহাস্যে জবাব দিলেন। আমিতাে উটের মালিক তাই আবেদনও আমার উটের জন্য। কাবার যিনি মালিক তিনি তা রক্ষা করবেন । এটাইতাে স্বাভাবিক ও নিয়মের কথা। আবরাহা ভুলেই গেলাে ‘অহংকার পতনের মূল'। বাদশাহ আবরাহা দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে বলে ওঠলাে। তিনি আমার হাত থেকে কা'বা রক্ষা করতে পারবেন না। আব্দুল মুত্তালিব প্রতি উত্তরে বললেন তা আপনি ও তিনিই ভালাে জানেন। আব্দুল মুত্তালিব তার উট নিয়ে চলে গেলেন।


কারাে মতে বাদশাহ আবরাহা একবার বললাে । শুনেছি এখানে একটি শান্তি ও নিরাপত্তার ঘর আছে। এটিকে ধ্বংস না করে দেশে ফিরবাে। এর শান্তি ও নিরাপত্তা বিনষ্ট করবােই করবাে । আব্দুল মুত্তালিব বললেন। অতীতে কেউ পারেনি। পারবেন না আপনিও। এগিয়ে চললাে আবরাহা। বিমর্ষ বদনে ফিরে এলেন আব্দুল মুত্তালিব। গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে আরববাসীদেরকে বললেন । যদি জীবন বাঁচাতে চাও পাহাড়ে চলে যাও।

আর তিনি চলে গেলেন কয়েকজন সরদার নিয়ে হারাম শরীফে। কাবার দরজা ধরে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন। হে কা’বার মালিক! আপনি আপনার ঘর কা'বা ও এর খাদেমদের রক্ষা করুন। হে আল্লাহ! বান্দাহ নিজের ঘর হিফাজত করে। তুমিও তােমার ঘর হিফাজত করাে। মজার ব্যাপার হলাে কা'বা ঘরে থাকা ৩৬০টি মূর্তির কথা তারা ভুলে গেলাে। প্রার্থনা একমাত্র আল্লাহর কাছেই জানালাে। দু'য়া করে আব্দুল মুত্তালিব ও তার সাথিরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাে।


বাদশাহ আবরাহা বীর দর্পে বিশেষ হাতি মাহমুদ নিয়ে মক্কায় প্রবেশে এগিয়ে যায়। মাহমুদ হঠাৎ ধপাস করে বসে পড়ে। প্রচণ্ড মারপিটে আহত হয় মাহমুদ। কিন্তু সেতাে নড়েই না। এদিক-সেদিক দৌড়ে পালায় । কাবা অভিমুখ হলেই গ্যাট হয়ে বসে পড়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে ছােট ছােট পাখি। ঠোঁটে ও পাঞ্জায় পাথর কণা। বর্ষণ করে পাথর বৃষ্টি। আবরাহা বাহিনীর ওপর। প্রচণ্ড আক্রমণে। শুরু হয় আবরাহা বাহিনীর প্রচণ্ড চুলকানি। চুলকাতে চুলকাতে খসে পড়ে তাদের চামড়া ও গােশতাে। বের হয় রক্ত ও পুঁজ। দেখা যায় শরীরের হাড়। ওরা যেনাে সব চর্বিত চর্বণ ও জাবর কাটা তৃণলতার মতাে। এ দশা হয় বাদশাহ আবরাহারও।

ভোঁদৌড়ে পালিয়ে যায় পথ প্রদর্শক নুফাইল ইবনে হাবীব খশয়ামী । দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয় লাশের মিছিল। আবরাহাও ধরাশায়ী হয় খাশআস এলাকায়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ওখানেই সে। চুরমার হয় সব ক্ষমতার দাপট গর্ব ও অহংকার। আর আবাবিল পাখির আক্রমণ হয় মুজদালিফা ও মিনার মধ্যবর্তী স্থান মহাসসির উপত্যকায়। এটাই হলাে আসহাবে ফিলের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার স্থান। এ বিশাল ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। হয় আরব্য কবিতার সরস খােরাক। প্রকাশ পায় মহান আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতা। সাত কি দশ বছর পর্যন্ত কুরাইশরা সকল ধরনের পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদাত করে। এ বছরটি ইতিহাসে স্থান করে নেয় আমুল ফিল’ হিসেবে। আর এভাবেই আল্লাহ তার ঘর হেফাজত করলেন। আবরাহার হাত থেকে। (সূরা ফিল অবলম্বনে)।
Next Post Previous Post