হাদীসের পরিচয় | হাদীসের আলোচ্য বিষয় ও উদ্দেশ্য | হাদীসের প্রকারভেদ | All Hadis
ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় মূল ভিত্তি হচ্ছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ এর মুখ নিঃসৃত বাণী আল হাদিস। এটা আল-কোরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যা। হযরত রাসুলুল্লাহ সাঃ এর মুখনিঃসৃত বাণী, কাজ, আদর্শ ও গুণাবলী সবই মানুষের জন্য হেদায়াত স্বরূপ, যাকে হাদীস বলা হয়। তাই ইসলামী শরীয়তে হাদিসের গুরুত্ব অত্যাধিক এবং অপরিসীম।
হাদীসের পরিচয়
معنی الحدیث لغةٍ হাদিসের আভিধানিক অর্থ ঃ-
حدیث (হাদিস) শব্দটি اسم তথা বিশেষ্য, এটা একবচন, বহুবচনে احادیث । মুল অক্ষর ح-د-ث। আভিধানিক অর্থ হলঃ
১. ضد القدیم পুরাতন এর বিপরীত।
২. القول কথা, বাণী।
৩. الوعظ উপদেশ।
معنی الحدیث اصطلاحا হাদিসের পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ- হাদিসের পারিভাষিক সংজ্ঞা দিতে গিয়ে হাদিছ বিশারদ গন বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
জমহুর মুহাদ্দিসীনের মতে,
নবী করিম সাঃ এর কথা, কাজ ও মৌন সমর্থন, অনুরূপভাবে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের কথা, কাজ ও মৌন সমর্থনকে ও হাদীস বলে।
আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহঃ বলেন,
হাদিস শব্দটি রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কথা, কাজ ও অনুমোদন অর্থে ব্যবহৃত হয়।
موضوع الحدیث হাদিসের আলোচ্য বিষয়:-
হাদিসের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আল্লামা কিরমানী রহঃ বলেন,
হাদিসের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আল্লাহ তাআলার রাসূল হিসেবে হযরত নবী করীম সাঃ এর সত্যতা তার জীবনের অবকাঠামোর বিস্তারিত বর্ণনা।
নিকাতুদ্দুরার গ্রন্থ প্রণেতা বলেন,
হাদিসের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে নবী করিম সাঃ এর যাত, যেখানে নবীজির কর্মপদ্ধতি, কথোপকথন ও সমর্থন ইত্যাদি বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হয়।
غرض الحدیث হাদিসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:-
হাদিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমগ্র মানবজাতিকে পথভ্রষ্টতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে হযরত রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,
আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, যদি উহা শক্তভাবে ধারন করো তবে তোমরা পথ ভ্রষ্ট হবে না উহা হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ বা হাদীস।
সুতরাং হাদিসের একান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এমন এক সোনালী সমাজ বিনির্মাণ, যেখানে রয়েছে মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপে কল্যান আর শান্তি।
হাদিসের প্রকারভেদসমূহ
সনদ অনুযায়ী হাদিস প্রথমত দুই প্রকার।
১. المتواتر
২. الاحاد
১. المتواتر এর পরিচয়
ক. আভিধানিক অর্থঃ- متواتر শব্দটি বাব تفاعل থেকে اسم فاعل এর সীগাহ। অর্থ হলো التعاقب ধারাবাহিকতা।
খ. পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ- হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, যে হাদীসের বর্ণনাকারী প্রত্যেক যুগে অসংখ্য হবে যা নির্দিষ্টভাবে গণনা করা সম্ভব নয় তাকে মুতাওয়াতির হাদীস বলে।
২. الاحاد আহাদ এর পরিচয়
ক. আভিধানিক অর্থঃ- আহাদ احاد শব্দটি বহুবচন। আবিধানিক অর্থ হচ্ছে এক, অভিন্ন।
খ. পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ- জমহুর আলেমদের মতে, আহাদ বলা হয় এমন হাদিসকে যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা হাদিসে মুতাওয়াতির এর চেয়ে কম অর্থাৎ যে হাদিসে মুতাওয়াতির হাদিসের শর্তাবলী পাওয়া যায় না, তাকে আহাদ হাদিস বলে। উল্লেখ যে, আহাদ হাদিস আবার তিন প্রকার। যথাঃ- ১. مشھور (মাশহুর) ২. عزیز (আযীয) ৩. غریب (গরীব)
مشھور মাশহুর হাদীসের পরিচয়ঃ- মুফতি আমিনুল ইহসান রহঃ বলেন, যে হাদীসের বর্ণনাকারী সংখ্যা দুই এর অধিক তবে তা মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছে নি, তাকে মাশহুর হাদিস বলে।
عزیز আযীয হাদীসের পরিচয়ঃ- ডক্টর মাহমুদ ত্বহান বলেন, আজিজ ওই সব আহাদ হাদিসকে বলে, যার রাবির সংখ্যা কোন স্তরে দুই এর কম হয়নি।
غریب গরিব হাদীসের পরিচয়ঃ- ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেন, গরিব এই হাদিসকে বলে যে, হাদীসের বর্ণনাকারী যে কোন স্তরে শুধু একজন থাকে।
المرفوع মারফু হাদিসের পরিচয়ঃ- মিজানুল আখবার গ্রন্থকার বলেন, যে হাদীসের সনদ নবী করিম সাঃ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মারফু হাদীস বলে।
الموقوف মাওকুফ হাদিসের পরিচয়ঃ- যে সকল হাদিস সাহাবীগণের কাছ থেকে এসেছে। এতে বোঝা যায়, সাহাবীগণের কাজ, কথা, স্বীকৃতি কে মাওকুফ হাদিস বলে।
المقطوع মাকতু হাদীসের পরিচয়ঃ- যে সকল হাদীসের সনদ তাবেয়ী পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মাকতু হাদীস বলে।
মতন অনুসারে হাদিস তিন প্রকার। যথাঃ- ১. قولی ২.فعلی ৩.تقریری
১। حدیث قولی হাদিসে কাওলিঃ- মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের পবিত্র মুখে নিঃসৃত বানিকে হাদিসে কাওলী বা বাণী সূচক হাদীস বলা হয়।
২। حدیث فعلی হাদিসে ফে’লিঃ- মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ স্বয়ং রাসূল হিসেবে যে সকল কাজ, কর্ম সম্পাদন করেছেন এবং কোন সাহাবী তা বর্ণনা করেছেন অথবা কোন সাহাবী ও তাবেয়ীগন কোন কর্ম করেছেন, তাকে হাদিসে ফে’লি বা কর্মসূচক হাদিস বলে।
৩। حدیث تقریری হাদিসে তাকরিরিঃ- সাহাবীগণ মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর সম্মুখে সম্পর্কিত যে কথা বলেছেন বা যে কাজ করেছেন এবং রাসুলুল্লাহ তার প্রতিবাদ করেননি বা নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন, তদ্রুপ সাহাবীগণ ও তাবেঈগণ যাতে মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন, তাকে হাদিসের তাকরিরি বা সম্মতিসূচক হাদীস বলা হয়।
মুনকাতি হাদিস তিন প্রকার। যথাঃ ১. معلق (মুআল্লাক) ২. معضل (মু’দাল) ৩. مرسل (মুরসাল)
১। حدیث معلق মুআল্লাকঃ- যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের সূত্রে প্রথম দিকে অর্থাৎ তাবেয়ীর অথবা তাবেয়ীর পর কোন বর্নানাকারীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুআল্লাক হাদীস বলে।
২। حدیث معضل মু’দালঃ- যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের সূত্রের মধ্যখান থেকে দুই বা ততোধিক বর্ণনাকারীর নাম একসাথে বাদ পড়েছে, তাকে মুদআল হাদিস বলে।
৩। حدیث مرسل মুরসালঃ- যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের সূত্রের শেষ দিকে কোন বর্ণনাকারী নাম অর্থাৎ কোন সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুরসাল হাদীস বলে।
সহীহ বা বিশুদ্ধ হওয়া হিসেবে হাদিস সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত
১. الحدیث الصحیح সহীহ হাদীসের পরিচয়ঃ- যে হাদীসের বর্ণনাকারীগণ অত্যান্ত বিশ্বস্ত এবং তাদের স্মরণ শক্তি খুবই প্রখর। আর যাদের বর্ণনা সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বর্ণনার বিপরিত নয়।
২. الحدیث الحسن হাসান হাদীসের পরিচয়ঃ- যে সহিহ হাদিসের রাবীদের স্মৃতির মধ্যে সামান্য ভুল ত্রুটি বিদ্যমান থাকে। যা অন্য কোন উপায়ে দূরীভূত হয় না
৩. الحدیث الضعیف জয়ীফ হাদীসের পরিচয়ঃ- যে হাদিস সহিহ এবং হাসান হাদিস এর শর্তসমূহ সম্পূর্ণ বা কিছু শর্ত বাদ পড়ে যায়, তাকে জয়ীফ হাদীস বলে।
যে হাদিস এর গ্রহণযোগ্যতা নেই এমন হাদিস তিন প্রকার।
১। الحدیث الموضوع হাদিসে মাওদুঃ যে হাদীসের বর্ণনাকারী জীবনে কোন এক সময় ইচ্ছাপূর্বক হযরত নবী করীম সাঃ এর নামে মিথ্যা রচনা করেছেন বলে প্রমাণিত।
২। الحدیث المتروک হাদিসে মাতরুকঃ- যে হাদীসের বর্ণনাকারী সাধারণ কাজ কারবারে মিথ্যা কথা বলেন।
৩। الحدیث المبھم মুবহাম হাদিসঃ- যে হাদীসের রাবী সঠিক পরিচয় পাওয়া যায়নি যাতে তার গুনাগুন বিচার করা যেতে পারে। মুহাদ্দিসীনদের মতে, এরুও ব্যক্তি যিনি সাহাবী নন বিচার-বিবেচনাব্যতীত সহিহ হাদিস গ্রহণ করা যাবে না।