চার ইমামের জীবনী | চার ইমামের সংক্ষিপ্ত জীবনী | Biographies of four Imams
আমরা আজ ইসলামকে যত সহজে পেয়েছি। ইসলাম কিন্তু তত সহজে আসেনি। ইসলামের জন্য নবী, সাহাবী, তাবেয়ী, ইমামগন কষ্ট করেছেন। আজ আমরা জানবো চার ইমামের জীবনী সম্পর্কে। তারা তাদের জীবনে ইসলামের জন্য কীরকম কষ্ট স্বীকার করেছেন।
![]() |
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) ঃ- আবু হানিফা নোমান ইবনে সাবেত হিজরী ৮০ সনে জন্মগ্রহণ করেন। সাবেতের পিতা ছোটবেলায় সাবেতকে নিয়ে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর কাছে গমন করলে, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু তাঁর এবং তার সন্তান-সন্ততির জন্য বরকতের দোয়া করেন। আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ আলাইহির উচ্চ মাকাম লাভ করেছিলেন। তা সবাই দোয়ারই ফল। তিনি ছিলেন একজন রেশম ব্যবসায়ী। কুফায় রেশমি কাপড় বিক্রি করতেন। এরপর তিনি ফিকহের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী, খোদাভীতি ও বদান্যতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ এবং এমন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব। যিনি কেবল স্মৃতি সংরক্ষিত হাদিস ভান্ডার থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন। তাঁর ছিল সর্বজনস্বীকৃত যোগ্যতা, শুভদৃষ্টি ও বিবেচনা ফিক্বহের পরিপক্কতা এবং তার পরিচালনা ও নেতৃত্ব প্রদানের পূর্ণ দক্ষতা। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যখন কুফায় শুভাগমন করেন। তখন তিনি তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এজন্য অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম তাকে তাবেয়ী হিসেবে গণ্য করেন। অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সাথে ও তার সাক্ষাৎ হয়। যেমন আবদল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সহ প্রমুখ। তিনি মহান ব্যক্তিদের কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন। যেমন হযরত আতা, শাবী, ইকরামা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু প্রমুখ।
তার কাছ থেকে হযরত ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ আশশাইবানি, হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক বিন হামমাম, আব্দুল্লাহ বিন মুবারক, আবি নুয়াইম, ইমাম আওযায়ি, ইমাম সাওরি রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বহুসংখ্যক বিখ্যাত আলেম দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করেন এবং ফিকাহ গ্রহণ করেন। ফিকাহ বিস্তারে অন্যান্যের ফকিহগনের মধ্যে তার আসন সবার উচ্চে। ইমাম শাফি রহমাতুল্লাহ আলাই তার সম্পর্কে বলেন, ফিকহের ক্ষেত্রে সকল মানুষ ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি এর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ইবনে মুবারক রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ আলাইহি ফিকাহ শাস্ত্রে সকল মানুষের চেয়ে অভিজ্ঞ। ফিক্বহের ক্ষেত্রে আমি তার মত অন্য কাউকে দেখিনি। ফিকাহ শাস্ত্রে সাথে সাথে তিনি ছিলেন সনদের ক্ষেত্রে বেশি পারদর্শী ও হাদীসের ক্ষেত্রে তিনি সংরক্ষণকারী। কারণ তাবেয়ী মধ্য হতে বড় বড় মুহাদ্দিসের সাথে তার ছিল সুসম্পর্ক, ওঠাবসা। তার আবাসস্থল ছিল কুফায় যা ছিল হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর খেলাফতের আমল থেকে বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরামের বাসস্থান। মক্কা মুকাররমা, মদিনা মনোয়ারা এবং বসরায় তিনি বহুবার ভ্রমণ করেন। এ সমস্ত দেশ ছিল হাদিস এবং শরয়ী ইলম চর্চার কেন্দ্রভূমি।তাঁর সংকলিত ও প্রণীত গ্রন্থের মধ্যে মসনদে ইমামুল আজম, আল ফিকহুল আকবার, কিতাবুল আসার, কিতাবুর রাদ্দে আলাল কাদরিয়া, কিতাবুল ইলম, মাকাতিব ওয়া ওয়াসিয়া লে আবি হানিফা (পত্রাবলী), কাসিদাতু নোমান ইত্যাদি সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি ১৫০ হিজরী সনে ১২ জমাদিউল উলা শাহাদাত বরণ করেন। কুফা শহরে তাকে দাফন করা হয়।
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে এই পোস্টি পড়ুন...
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর জীবনী
ইমাম মালেক রাহমাতুল্লাহি আলাইহিঃ- ইমামু দারুল হিজরত মালেক ইবনে আনাস ইবনে মালেক ইবনে আবু আমের রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু। মদিনা-মনোয়ারায় ৯৩ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। মদীনা মুনাওয়ারার ওলামায়ে কেরামের কাছ থেকে এলেম হাসিল করেন। তাদের শীর্ষে ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে হুরমুজ রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি ছিলেন ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর আযাদকৃত গোলাম। হযরত নাফে, ইমাম জুহুরী রহমাতুল্লাহ আলাইহির ফিকাহ শাস্ত্রে। তার ওস্তাদ রবিয়া ইবনে আব্দুর রহমান রহমাতুল্লাহ আলাইহি এর কাছ থেকে ইলমে দ্বীন শিক্ষা গ্রহণ করেন।
তিনি যখন ১৮ বছর বয়সে উপনীত হন তখন তার ওস্তাদগন তাকে হাদীস ও ফিকহের সনদ প্রদানের পর তিনি পাঠদানের জন্য সমাসীন হন। ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ওলামায়ে কেরামের মধ্য হতে সত্তর জন ওস্তাদ আমাকে সনদ ও স্বীকৃতি না দিয়েছেন, ততদিন পর্যন্ত আমি হাদিস ও ফতুয়া প্রধান উপবিষ্ট হয়নি। ওলামায়েকেরাম তার ইমাম হওয়ার যোগ্যতা দ্বীনদারী এবং খোদাভীতির ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। ইমাম শাফি রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, ইমাম মালিক রহমতুলা আলাহি আল্লাহর প্রকৃষ্ট দলিল। যখন তিনি কোন হাদিস বর্ণনা করতে চাইতেন তখন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস সম্মানে উত্তম পোষাক পরিধান করতেন এবং সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। হাদিসের মজলিসে উচ্চ আওয়াজে কথা বলাকে তিনি অপছন্দ করতেন। তিনি মুয়াত্তা কিতাব সংকলন করেন। এই কিতাব সংকলনের অনেক কষ্ট স্বীকার করেন। এ কাজে তিনি প্রায় ৪০ বছর কাটিয়ে দেন। সমগ্র বিশ্বে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। জনসাধারণ এবং ওলামায়ে কেরাম তার জীবদ্দশায় তার নিকট আগমন করে তাকে দেখে মুগ্ধ হতেন। ইমাম সুফিয়ান সাওরী, ইমাম লাইস, ইমাম আওযায়ী ও ইমাম শাফি রহমাতুল্লাহ আলাইহি এবং বরেণ্য ওলামায়ে কেরাম তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেন। হিজরী ১৭৯ সালের ১১ রবিউল আউয়াল তিনি মদিনায় তৈয়্যেবা ইন্তেকাল করেন। জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফন করা হয়।
📙আরো পড়ুন.....
ইমাম শাফেঈ রহমতুল্লাহি আলাইহিঃ- আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আশ শাফেয়ী আল- হাসেমী ছিলেন আবদুল মোতালেব ইবনে আবদে মানাফ এর বংশধর। তিনি হিজরী ১৫০ সন ফিলিস্তিনের অন্তর্গত গাজা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের দুই বছর পর তার পিতা ইন্তেকাল করেন। তার মা তাকে মক্কা মুকাররমায় নিয়ে যান এবং সেখানেই মায়ের কোলে ইয়াতিম অবস্থায় তিনি বড় হন। মক্কা মুকাররমায় মুফতী মুসলিম উদ্দিন রহমতুল্লাহি আলাইহি এর সাহাচর্য গ্রহণ করেন এবং তার কাছেই ফিকহের গভীর জ্ঞান লাভ করেন। অবশেষে পনের বছর বয়সে তাকে ফতুয়া প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর তিনি হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট গমন করেন এবং তার কাছ থেকে মুয়াত্তা কিতাবের জ্ঞান অর্জন করেন। আর মাত্র ৯ রাতে মুয়াত্তা কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন। ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি তার মেধা ও স্মৃতিশক্তি প্রশংসা করতেন। তিনি আবু হানিফা রহমাতুল্লাহ আলাইহির ছাত্র মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশশাইবানি রহমতুল্লাহি নিকট থেকে এর জ্ঞান অর্জন করেন এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান ইবনে ওয়াইনা, ফুদাইল ইবনে আশাজ রহমাতুল্লাহ আলাইহিসহ বহু সংখ্যক ওলামায়ে কেরাম থেকে তিনি হাদিস বর্ণনা করেন। তার ব্যাপারে হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুলা আলাহি বলেন, তিনি পবিত্র কোরআন এবং হাদিস সমস্ত মানুষের চেয়ে বেশি বুঝছেন। তিনি সর্বপ্রথম কিতাবুর রিসালা নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত কিতাব গুলো প্রসিদ্ধি লাভ করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিতাব 'কিতাবুল উম্মাহ'। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী সুন্দর ব্যাখ্যা প্রদান ও অভিজ্ঞ। সুন্দর বর্ণনায় দক্ষ, সবচেয়ে মজবুত দলিল উপস্থাপনকারী, দৃড় বক্তব্য প্রদানকারী, সুদর্শন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তার মাযহাবের নামকরণ করা হয় শাফেয়ী মাযহাব। তিনি তার মাযহাবে নিজস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করেন। হিজরী ২০৪ সনে রজব মাসের শেষ দিন বৃহস্পতিবার মিশরে ইন্তেকাল করেন। ফুস্তাত নামক স্থানে তাকে দাফন করা হয়।
আরো জানতে আরো পড়ুন........
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহ আলাইহিঃ- শাইখুল ইসলাম ইমামুস সুন্নাহ আবু আব্দুল্লাহ আহমদ ইবনে হাম্বল ইবনে হেলাল ইবনে আসাদ আশশাইবানি ১৬৪ সনে রবিউল আউয়াল মাসে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই বড় হন। তিনি হাদিস সংকলন ও সংরক্ষণের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অবশেষে যুগ শ্রেষ্ঠ মহাদেশ হিসাবে প্রসিদ্ধিলাভ করেন। তিনি কুফা, মক্কা মুকাররমা, মদিনা-মনোয়ারা এবং ইয়েমেনে ভ্রমণ করেন। ইমাম শাফি রহমাতুল্লাহ আলাইহি এবং অন্যান্যের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন এবং পরবর্তীতে স্বতন্ত্র মুজতাহিদ হিসেব প্রতিষ্ঠিত হন। হাদিসের ক্ষেত্রে তার প্রসিদ্ধ ওস্তাদ ছিলেন সুফিয়ান বিন ওয়াইনা, ইয়াহইয়া বিন সাইদ আল কাত্তান, আবু দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি। তার কাছ থেকে যারা হাদিসের এলেম অর্জন করেছেন। তারা হলেন ইমামুল হাদিস ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদি, আলী ইবনুল মাদীনী রাহিমাহুমুল্লাহ আনহু। তিনি তৎকালীন যুগের সৃষ্ট খালকে কোরআন বা কোরআন সৃষ্ট না অনাদি সংক্রান্ত ফিতনায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। জেলে বন্দি করে অমানবিক নির্যাতন চালানো হলেও তিনি স্বীয় সঠিক মতে অবিচল থাকেন। তিনি দুনিয়ার প্রাচুর্য দাঁড়াও পরীক্ষিত হন। কিন্তু আকৃষ্ট বা নীতি বিচ্যুত হননি। ইমাম আলী ইবনে মাদানী রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা দুজন ব্যক্তি দ্বারা ইসলামকে শক্তিশালী করেছেন। তারা হলেন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু রিদ্দার যুদ্ধের সময় ইসলামের উপকার করেন এবং ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি চরম বিপর্যয়ের দ্বীনে ইসলামের উপকার করেন। ইমাম শাফি রহমাতুল্লাহ আলাইহি বলেন, আমি বাগদাদ থেকে চলে আসছি আর সেখানে আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর চেয়ে অধিক ফিকাহ শাস্ত্রে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, অধিক দুনিয়া বিরোধী এবং অধিক ইলমের অধিকারী অন্য কাউকে রেখে আসেনি। এর প্রমাণ হিসেবে তার মসনদ কিতাবটাই যথেষ্ট। যার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার হাদীস রয়েছে। এছাড়াও তিনি কিতাবুল আমল, কিতাবুত তাফসীর, কিতাবুল মানাসেক, কিতাবুল ফাজায়েল, কিতাবুল মাসায়েল, কিতাবুল এতেকাদ, কিতাবুল ইমাম, কিতাবুল যুহুদসহ অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ২৪১ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন এবং তাকে মক্কা মুকাররমা সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে দাফন করা হয়।
পোস্টি ভালো লাগলে আরো পড়ুন...