মহররম মাসের ফজিলত ও আমল এবং গুরুত্ব | আশুরার দিনে যা যা করনীয় এবং যা যা বর্জনীয় | আশুরার ফজিলত | আশুরার রোজা
মুহাররম মাস আরবি বছরের প্রথম মাস। নিষিদ্ধ চার মাসের অন্যতম মাস হলো মহররম মাস। এ মাস কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা হযরত হোসাইন রাঃ এর শাহাদাতের ইতিহাস কে কেন্দ্র করে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। এছাড়া এ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ পাক তাঁর সৃষ্টির অসংখ্য কাজ সম্পাদিত করেছেন।
মহররম বা আশুরার গুরুত্বঃ-
মহররম মাস বা আশুরার গুরুত্ব অপরিসীম। মহররম মাসে অথবা আশুরার দিনে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন অনেক ঘটনা ঘটিয়েছেন। তা হলোঃ
• আশুরার দিনে আল্লাহপাক রাব্বুল আলামিন পৃথিবী এবং আসমান জমিন সৃষ্টি করেন।
• এ দিনে হযরত আদম আঃ কে সৃষ্টি করা হয়।
• এদিনেই হযরত আদম আঃ কে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়।
• এ দিনে হযরত আদম আঃ এর তওবা কবুল করা হয়।
• এ মহান দিনে মহান আল্লাহ পাক নবী হযরত ইদ্রিস আঃ কে চতুর্থ আসমানে আসীন করেন।
• এ দিনে হযরত নূহ আঃ কে মহাপ্লাবনের পরে এদিনেই জূদী পাহাড়ে তার কিশতী অবস্থান করে।
• এ দিনে হযরত ইব্রাহিম আঃ এর আগুনের কুন্ডলী ফুল বাগানে পরিণত হয়।
• এদিনেই হযরত দাউদ আঃ এর গুনাকে ক্ষমা করেন।
• এদিনেই আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন হযরত ইউসুফ আঃ কে তার পিতা হযরত ইয়াকুব আঃ এর কাছে বহু দিনের বিচ্ছেদ ব্যথার পর ফেরত প্রদান করেন।
• এদিনেই হযরত আইয়ুব আঃ কে কঠিন রোগ থেকে মুক্তি প্রদান করেন।
• এদিনে আল্লাহপাক হযরত মুসা আঃ এর সাথে তুর পাহাড়ে কথা বলেন এবং তার উপর তাওরাত কিতাব অবতরণ করেন।
• এই দিনে হযরত মুসা আঃ স্বীয় কাওম সহ নীল নদ পার হন এবং সৈন্যসামান্ত সহ ফেরাউনের সলীল সমাধি ঘটে।
• এ দিনে হযরত ইউনুস আঃ এর তওবা কবুল করা হয়।
• এ দিনে হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল আঃ এর জন্ম হয়।
• এদিনেই হযরত সোলায়মান আঃ এর জন্য তার রাজত্ব কে উত্তম ভাবে পুনরায় প্রদান করেন।
• এদিনেই হযরত ঈসা আঃ কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়।
• এ দিনেই হযরত জিবরাঈল আঃ রহমত নিয়ে অবতীর্ণ হন।
• এদিন এই মহান আল্লাহ পাক আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সঃ এর ছোট বড় সব গুনাহ মাফ করেন।
• সর্বশেষে কোন এক মহররম মাসের ১০ তারিখে কেয়ামত সংঘটিত হবে।
আশুরার ফজিলত
আশুরার অনেক ফজিলত রয়েছে। আশুরার দিনটিতে যে রোজা রাখবে, তারা যেন পূর্ণ একটি বছরে রোজা রাখল এবং অতি উত্তম প্রতিদান লাভ করতে সক্ষম হল। যে ব্যক্তি এ দিনে কোন উলঙ্গ কে কাপড় পরিধান করাবে, মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাকে কঠিন আযাব থেকে পরিত্রাণ প্রদান করবেন। যে ব্যক্তি এ দিনে কোন অসুস্থ ব্যক্তিকে সেবা করবে, মহান আল্লাহ পাক তাকে মহান প্রতিদান দান করবেন। এ দিনে যে ব্যক্তি কোন এতিমের মাথায় হাত বুলাবে অথবা কোন অনাহারীকে অন্নদান করবে অথবা পানীয় পান করাবে, আল্লাহ পাক তার বিনিময়ে তাকে বেহেশতের খাঞ্জা হতে খানা খাওয়াবেন এবং তাকে সালসাবীলের পানিয় পান করাবেন।
আশুরার রোজার ফজিলত
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলে করীম সাঃ মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত সূত্রে আগমন করলেন। তখন তিনি সেখানকার ঈহুদীগণকে আশুরার দিন রোযা রাখতে দেখলেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এ দিনে রোজা রাখছো কেন? তারা উত্তরে বলল, এটা এক বিরাট সম্মানিত দিন! এদিনে আল্লাহপাক হযরত মুসা আঃ এবং তাঁর উম্মতকে নাজাত দিয়েছেন এবং ফেরাউন ও তার বাহিনী কে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেন।
তাই হযরত মুসা আঃ উহার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এ দিনে রোযা পালন করেন বিধায় আমরা এই দিনে রোজা রাখি। এতদাশ্রবণে রাসূলে করীম সাঃ বললেন, হযরত মুসা আঃ এর নাজাতে কৃতজ্ঞতা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি উপযুক্ত ও অধিক হকদার। অতঃপর হযরত রাসূলে পাক সাঃ নিজেও আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং মুমিনদের রোজা রাখার হুকুম প্রদান করেন। (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে আরো বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যখন হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার রোজা রাখেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে রোজা রাখার হুকুম প্রদান করেন। তখন তারা আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এদিনটি এমন যে এ দিনের প্রতি ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান জাতির লোকেরা সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। অথচ আমরা তাদের বিরোধিতা করার জন্য আদিষ্ট। একথা শুনে হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু ইসলাম বলেন, আমি যদি আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকি তাহলে মহরমের ৯ তারিখে ও রোজা রাখব। (মুসলিম শরীফ)
হযরত আবু হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রমজানের রোজার পর উৎকৃষ্ট রোজা মহররম মাসের আশুরার রোজা। (মুসলিম শরীফ)
আবু কাতাদা রাঃ হতে বর্ণিত, হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেন, আশুরার রোজা পালনে আমি আল্লাহ পাকের দরবারে আশা করি যে তিনি আমার বিগত বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (মুসলিম শরীফ)
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাঃ বলেন তোমরা ৯ ও ১০ ই মহররমে রোজা পালন করে ইয়াহুদীদের বিরোধিতা কর। (তিরমিজি শরিফ)
অবশেষে বলা যায় যে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ৯ এবং ১০ই মহরম মাসে আশুরার রোজা পালন করা।
মহররম মাসের আমল
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাঃ হতে বর্ণিত আছে, কেউ যদি এ মাসের প্রথম রাতে সূরা ফাতিহার সাথে ১০ বার সূরা ইখলাস দু'দু রাকাত করে মোট ৮ রাকাত নামাজ আদায় করে তবে তার এবং তার পরিবার পরিজনকে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাফায়াত করবেন।
হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দী রহঃ বলেছেন, এ মাসের প্রথম তারিখে রাতে যে ব্যক্তি একবার সূরা ফাতিহা ১০ বার সূরা ইখলাস এবং
سبوح قدوس ربنا ورب الملٕکة والروح
যে ব্যক্তি উপরিউক্ত এ দোয়াটি একবার পাঠ করে মোনাজাত করবে সে অশেষ সওয়াব ও অফুরন্ত নিয়ামত লাভ করবে।
মহররম মাসে যা যা করণীয় এবং যা যা বর্জনীয়
বিশ্বে মুসলিম জাতির মধ্যে একদল রয়েছে শিয়া। যারা মহররম মাস বা আশুরার দিন আসলে নিজেদের শরীরে চাবুক অথবা ধারালো জিনিস দিয়ে আঘাত করতে থাকে। আর বলতে থাকে হায় হোসাইন হায় হোসাইন, যা সম্পূর্ণ শরীয়তে নিষিদ্ধ।
এছাড়াও মহররম মাসের আশুরা কে কেন্দ্র করে তাজিয়া, মিছিল, হাহুতাশ, আহাজারি করা, শোক প্রকাশ করা, সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী কাজ। এসব কাজ শরীয়ত সম্মত নয় এবং আমাদেরকে আমাদের পরিবার, সমাজ কে এইসব কাজ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
পক্ষান্তরে আশুরার দিনে অর্থাৎ দশে মহররমে নফল নামাজ আদায় করা, রোজা রাখা, পবিত্র কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা, দোয়া দরুদ পড়া, হামদ নাত গাওয়া, ওয়াজ নসিহত (জীবনী আলোচনা) করা ও আর্ত-মানবতার সেবায় গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা শরীয়তের দৃষ্টিতে পুণ্যের কাজ। অতএব এ দিনে বেদয়াতি কাজ পরিত্যাগ করে নেক কাজ করে আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।